সুখরঞ্জন বালি কীভাবে ভারতের কারাগারে পৌঁছালেন তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

0
29

সুখরঞ্জন বালি কীভাবে ভারতের কারাগারে পৌঁছালেন তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

মোঃ ইমদাদুল হক মিলনঃ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া সুখরঞ্জন বালি কীভাবে ভারতের কারাগারে পৌঁছালেন তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

২০১২ সালের ৫ নভেম্বর সকাল। সেদিন অপহৃত হওয়ার পর তার সাথে কী কী ঘটেছে বাসস’র সাথে আলাপকালে সেগুলো তুলে ধরেছেন সুখরঞ্জন বালি।

সুখরঞ্জন বালি বলেন, ‘আমাকে একটি খালি রুমে আটকে রাখা হয়। বাইরে কোনো শব্দ ছিল না, ঘরে কোনো জানালা বা কোন ফাঁকা ছিল না, যা দিয়ে কোনোরকম আলো-বাতাস ভেতরে আসতে পারে। আমাকে মাঝে মাঝে অল্প করে খাবার দেওয়া হতো। সেখানে কিছু লোক ছিল, যারা আমাকে খাবার দিত বা পাহারা দেওয়ার জন্য আসত। তারা নীল রংয়ের পোশাক পরা থাকত।’

তিনি বলেন, ‘এর দুদিন পর আমাকে ওই রুম থেকে বের করে অন্য একটি রুমে নেওয়া হয়। সেখানে আমাকে নিয়ে তারা জোর করে সাঈদী হুজুরের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি নিতে চান। ওই রুমে অনেকগুলো ক্যামেরা লাগানো ছিল। আমার ভাইয়ের হত্যায় সাঈদী হুজুর জড়িত কি না জানতে চাইলে আমি অস্বীকার করি এবং বলি, যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তাদের আমি চিনি, তাদের বিরুদ্ধে আমি সাক্ষ্য দিতে পারব। কিন্তু তারা বারবার আমাকে সাঈদী হুজুরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলেন এবং একপর্যায়ে আমাকে মারধরসহ বৈদ্যুতিক শক দেয়, নির্যাতন করে।’

সুখরঞ্জন বালি বলেন, ‘তারা টাকা দিয়ে লোভ দেখানোর চেষ্টা করে। এরপরও রাজি না হলে অমানবিক নির্যাতন চালায়। সেখানে টানা কয়েকদিন ছিলাম। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত। তখন তিন-চারজন লোক জিজ্ঞাসাবাদ করত।’

সুখরঞ্জন বালি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে সে দৃশ্য আমি আমার বাড়ির পাশে টয়লেটের ভেতর লুকিয়ে থেকে নিজ চোখে দেখেছি। সেখানে সাঈদী হুজুরকে আমি দেখিনি। তখন এ নামে কাউকে আমি চিনতামও না। উনি আমাদের এলাকা থেকে দুবার নির্বাচিত এমপি ছিলেন। তখন উনার সম্পর্কে জানি ও চিনতে পারি। হুজুর নিরাপরাধ, নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে শত নির্যাতন সহ্য করেও আমি সাক্ষ্য দেইনি।’

তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে দেশে ফিরেও আমি নিজ এলাকায় পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে যেতে পারিনি। নিরাপত্তার কারণে বাগেরহাটে আত্মীয় ও পরিচিতিদের সহায়তায় তাদের আশ্রয়ে ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘সাঈদী হুজুরের মামলায় সাক্ষ্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে আমাকে অপহরণ করে গুম করে নির্যাতন নিপীড়ন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং বিজিবি সহায়তায় বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে টানা ৫ বছর কারাবন্দী করে অবর্ণনীয় সাজা ভোগে বাধ্য করা হয়। অনেক ভয় ও আতঙ্কের পরও সাঈদী হুজুরের মৃত্যুর পর তার জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলাম। তারপর আবারও নিরাপত্তার কারণে আড়ালে চলে যাই।’

সুখরঞ্জন বালি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন নিরপরাধ নাগরিককে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরেকটি দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে তুলে দেয় কেমন করে?’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি যেতে না চাইলে জোর করে তারা আমাকে ধরে বিএসএফ সদস্যদের হাতে তুলে দেয়। বিএসএফ কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমাকে মারধর শুরু করে। বিএসএফ হিন্দিতে কথা বলছিল। আমি তাদের আমাকে না মারার জন্য বাংলায় বোঝাতে চেষ্টা করি। আমার কোনো কথা তারা বুঝতে পেরেছিল কি না জানি না। একপর্যায়ে বিএসএফ মোটা দড়ি দিয়ে পেছন দিক দিয়ে আমার হাত বেঁধে ফেলে।’

হাত বাঁধার সেই দাগ এখনো স্পষ্ট। সেটা তিনি প্রতিবেদককে দেখান।

সুখরঞ্জন বালি তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনায় বলেন, মোটা লাঠি দিয়ে বিএসএফ তাকে মারতে থাকে। এতে তিনি ডান হাতের কনুইতে প্রচণ্ড আঘাত পান। এখনো ডান হাত দিয়ে ভালোভাবে তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। বিএসএফ-এর মারের পরে তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা বেহুঁশ ছিলেন।

সুখরঞ্জন বালি বলেন, ‘আমি বিএসএফকে বলতে থাকি যে আমি ইচ্ছা করে এখানে আসিনি কিন্তু আমার কথা বুঝতে না পারায় তারা আমাকে বেধড়ক মারধর করে। আমাকে মারধরের আর কোনো কারণ বুঝিনি। বিএসএফের ক্যাম্পটির বিষয়ে জানতে পারি এটি বৈকারী বাজার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চব্বিশ পরগণা জেলার স্বরূপনগর থানা এলাকা। এরপর বশিরহাট জেলে আমাকে বাইশ দিন রাখা হয়। সেখানে একদিন আমাকে কোর্টেও নেওয়া হয়। এরপর নেওয়া হয় দমদম জেলে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here